উচ্চমাধ্যমিক
একাদশ শ্রেণী
দর্শন
দশম অধ্যায়
চার্বাক দর্শন
চার্বাক কথাটি কোথা থেকে এসেছে? তাই নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কারো কারো মতে এরা চারুবাক বা সুন্দর কথা বলতে বলে এই দর্শনের নাম চারুবাক বা অপভ্রংশের চার্বাক দর্শন। কেউ কেউ বলেন এরা শুধু চর্ব বা খাওয়ার কথা বলতেন বলে এই দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন। আবার কারও মতে এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা চার্বাক ঋষির নাম অনুসারে এই দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন।
এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে তাই নিয়ে মতবিরোধ আছে। কেউ কেউ বলেন দেবগুরু বৃহস্পতি হলেন এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। আবার কারও মতে চার্বাক ঋষি হলেন এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। যাই হোক না কেন এই দর্শন ভারতীয় দর্শনে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এরা ঈশ্বর মানে না, আত্মা মানে না, স্বর্গ-নরক মানেনা, বেদ পুরোহিত মানে না, এক কথায় কিছুই মানে না। চার্বাকদের আলোচনা কেউ পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা -
- চার্বাক জ্ঞানতত্ত্ব
- চার্বাক জড়তত্ত্ব
- চার্বাক নীতি তত্ত্ব
- চার্বাক ঈশ্বরতত্ব
- চার্বাকদের বেদ বিরোধিতা
চার্বাক জ্ঞানতত্ত্ব : ভারতীয় দর্শনে যথার্থ জ্ঞানের নাম প্রমা। প্রমার অর্থ যথার্থ জ্ঞান। প্রমার কারণকে বলা হয় প্রমাণ। ভারতীয় দর্শনের চারটি প্রমাণ স্বীকার করা হয়। যথা - প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। চার্বাকরা শুধুমাত্র প্রত্যকেই প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে জ্ঞান হয় তাই একমাত্র যথার্থ জ্ঞান। চার্বাকরা অনুমানের স্বীকার করে না। কারণ একটি অনুমান করতে হলে আর একটি অনুমান করতে হয় আবার তার জন্য আরেকটি। কাজেই অনুমানে অনাবস্থার দোষ ঘটে। উপমানও তাই। চার্বাক শব্দকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না। কারণ যিনি 100 কথা সত্য বলেছেন তার 101 তম কথাটি সত্য নাও হতে পারে। কাজেই প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ।
চার্বাক জড়তত্ত্ব : যেহেতু প্রত্যক্ষ একমাত্র প্রমাণ সেহেতু চার্বাকরা দেহ অতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কারণ একে প্রত্যক্ষ করা যায় না। আরবদের মধ্যে ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ (চার্বাকরা ব্যোমকে স্বীকার করে না কারণ একে প্রত্যক্ষ করা যায় না) চারটি মহা ভূত নিজেদের স্বভাব অনুযায়ী আকস্মিকভাবে মিলিত হয়ে চৈতন্য বিশিষ্ট উৎপন্ন করে। চৈতন্য দেহের গুন। এই চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা। চার্বাকদের এই মতবাদকে বলা হয় দেহাত্মবাদ বা জড়বাদ।
প্রশ্ন ওঠে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি জড়পদার্থ তাহলে এদের মিশ্রণে কিভাবে চৈতন্য উৎপন্ন হয়। চার্বাকরা এর উত্তরে বলেন পান, চুন, সুপারি এবং খয়ের এর কোনটির মধ্যে লাল রং নেই কিন্তু এদের মিশ্রণে লাল রং উৎপন্ন হয়। ঠিক তেমনি ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চতুর্ভুজ এর মধ্যে চৈতন্য না থাকলেও এদের মিশ্রণে চৈতন্য উৎপন্ন হয়। এরপরেও প্রশ্ন ওঠে চৈতন্য যদি দেহেরই গুণ হয় তবে তা সর্বদা দেহতে দেখা যায় না কেন। চার্বাকরা এর উত্তরে বলেন চাল জলে রেখে দিলে কিছুদিন পর তাতে মাদকীয়তা আসে। এই মাদকীয় তা পূর্বে ছিল না। পরে উপযুক্ত কারণ আশাতেই মাদকীয়তা দেখা যায়। কাজেই চৈতন্য দেহের গড়ন হলেও তা সর্বদা দেহতে দেখা যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
চার্বাক নীতি তত্ত্ব : যেহেতু দেহ অতিরিক্ত আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই সেহেতু চার্বাকরা জন্মান্তর বা পরলোকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কৃচ্ছতা সাধন এর মাধ্যমে পরলোক বা পরজন্মে সুখ প্রাপ্তির এদের কাছে অবান্তর। চার্বাকরা বলেন যেহেতু মৃত্যুতেই সব শেষ, দেহ বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনষ্ট হয়। সেতু চার্বাকরা বলেন যা কিছু সুখ ভোগ তা এই জীবনেই করতে হবে। ভারতীয় দর্শনের চারটি পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়। যথা - ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। চার্বাকরা এর মধ্যে কাউকেই চরম পুরুষার্থ বলে স্বীকার করেন। অর্থ হল গৌণ পুরুষার্থ। সাধারণ মানুষও এই মতে বিশ্বাসী বলে চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়। সুখবাদ প্রসঙ্গে চার্বাকদের সুবিখ্যাত নীতিটি হলো -
"যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ,
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।"
ওদের এই মতবাদের সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টোপাশের অসঙ্গত আত্ম সুখবাদের সাদৃশ্য আছে।
চার্বাক ঈশ্বরতত্ব : চার্বাকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কারণ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। চার্বাকরা বলেন ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ এই চতুর্ভুজ নিজেদের স্বভাব অনুযায়ী আকস্মিকভাবে মিলিত হয়ে এই জীবন ও জগৎ সৃষ্টি করেছে। এইখানে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই। চার্বাকদের জগত তত্ত্ব কে বলা হয় যদৃচ্ছাবাদ। ধূর্ত, ভন্ড, নিশাচর ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাতে ঈশ্বর কে সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই।
বেদ বিরোধিতা : চার্বাকরা চূড়ান্তভাবে বেদের বিরোধিতা করেন। এরা বেদের কোন কথা কে স্বীকার করেননি। তারা বলেন ধূর্ত ভন্ড নিশাচর ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য বেদের অর্থহীন শব্দ এবং অর্থহীন কলাপ ব্যবহার করা হয়েছে।
চার্বাকদের অনেক কথাই গ্রহণযোগ্য নয়। এই মতবাদ চরম এবং একদেশদর্শীর মতবাদ। বৈদিক যুগে চার্বাকরা যে এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস ও সত্যনিষ্ঠ দেখিয়েছেন তা আমাদের মনকে নাড়া না দিয়ে পারে না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ