ষষ্ঠ শ্রেণি
ইতিহাস সাজেশন
তৃতীয় অধ্যায়
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা
(প্রথম পর্যায় : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ - ১৫০০ অব্দ)
৩.১ সূচনা :
ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে চলা আদিম মানুষের কথা আমরা আলোচ্য অধ্যায়ে পড়ব। প্রস্তর যুগের শেষের দিকে স্থায়ী বসতবাড়ি, কৃষি কাজ এবং পশুপালন ঘিরেই মানবসভ্যতা এগিয়ে চলল। নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রমের জোরে আদিম মানুষ হয়ে ওঠে সভ্য। কৃষিকাজ বৃদ্ধির ফলে মানুষের জমির চাহিদা বাড়তে থাকে। এভাবেই শুরু হয় জমির লড়াই। জোট বদ্ধ মানুষের মধ্যে মতের অমিল দেখা দিল। শুরু হলো বিবাদ, আর নিজেরাই বিবাদ মিটিয়ে সমাজে নিয়ম অনুবর্তীতার সৃষ্টি করলো। জিনিসের চাহিদা বাড়লেও ধীরে ধীরে। শুরু হলো জিনিস নিয়ে জিনিস নেওয়া অর্থাৎ বিনিময় প্রথা। জোট বদ্ধ মানুষ এভাবেই সমাজ তৈরি করল। সমাজে কাজের ভিত্তিতে মানুষের ভোগ তৈরি হলো। ধীরে ধীরে সমাজে শিক্ষার প্রসার বাড়লো। তৈরি হলো বর্ণ বা লিপি। মানুষ শিখলো পাথরের পরিবর্তে ধাতুর ব্যবহার। আদিম গোষ্ঠীর সমাজে যে সমতার ধারণা ছিল, সভ্য সমাজে তা আর থাকলো না। তৈরি হলো শাসকগোষ্ঠী, যারা গোটা জনসমাজকে শাসন করতো। তৈরি হল নগর, আর এই নগর ও গ্রামকে ভিত্তি করেই ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠে মেহেরগড় সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার মতোই বিশাল সাম্রাজ্য।
৩.২ মেহেরগড় :
পাথরের পাশাপাশি ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ধাতু বলতে তামা কাঁসার ব্যবহার বোঝাত, - একে বলা হতো তামা ও পাথরের যুগ। পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের মেহেরগড়ে তামা - পাথরের যুগের একটি প্রত্নকেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। মেহেরগড়, বোলনগিরি পথের থেকে খানিক দূরে অবস্থিত। এটি কৃষিনির্ভর সভ্যতা ১৯৭৪ সালে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জাঁ ফ্রঁসোয়া জারিজ মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ পর্যন্ত মেহেরগড়ের সবথেকে পুরনো পর্যায় ছিল। এখানকার লোকেরা গম ও যব ফলাতে জানতো, ছাগল, ভেড়া ও কুজওয়ালা ষাঁড় ছিল পালিত পশু। এখানে যাঁতা পাওয়া গেছে। ইটের তৈরি বাড়িও পাওয়া গেছে। মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ পর্যন্ত। গম, যব ও কার্পাস এখানে চাষ করা হতো। কাস্তে, মাটির পাত্র, পাথর ও শাঁখ তৈরীর গহনা এখানে পাওয়া গেছে। তবে শাঁখ ও পাথরগুলি বাইরে থেকে আসতো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০০ পর্যন্ত মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্ব। এই যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল পাত্র গুলি চুল্লিতে পুড়িয়ে সেগুলির গায়ের নকশা ও ছবি আঁকা হতো। এর রং দুরঙা, বহু রঙা মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। সিলমোহরের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। গ্রামীণ সমাজ জটিল রূপ নিতে শুরু করেছিল।
মেহেরগড়ের সমাধি :
মেহেরগড় সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সমাধিক্ষেত্র। সমাধিতে মৃতদেহ সুজাসুজি বা কাত হয়ে শুয়ে দেওয়া হতো। মৃতের সঙ্গে দেওয়া হতো নানা জিনিসপত্র। যেমন পাথরের গয়না, শাঁখ ও কুড়ুল প্রভৃতি। এছাড়া সমাধিতে দেওয়া হতো নানা গৃহপালিত পশুও। সমাধিতে মূল্যবান পাথরও পাওয়া গেছে। মৃত দেহকে লাল কাপড় জড়িয়ে, লাল রং মাখিয়ে সমাধি দেওয়া হতো।
৩.৩ হরপ্পা সভ্যতার কথা :
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে হরপ্পা এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহেঞ্জোদারো দুটি প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়। দুইটি প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল সিন্ধু নদকে ঘিরে। তাই এই সভ্যতার নাম দেওয়া হয়েছে সিন্ধু সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতা প্রায় ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হল হরপ্পা নগর। এখানের প্রাপ্ত লিপিগুলি পড়া সম্ভব হয়নি। এখানকার লোকেরা তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানতো। তাই এই যুগে তাম্র ও ব্রঞ্জের যুগ নামে পরিচিত। এই সভ্যতার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার পাঁচশো অব্দ পর্যন্ত ধরা যায়।
হরপ্পা আবিষ্কারের কথা :
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব প্রদেশের সাহিওয়াল জেলায় পৌঁছানো চার্লস ম্যাসনের ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডার এর সঙ্গে পুরুষ এখানে যুদ্ধ হলেও স্থানটি গুরুত্ব কেউ জানত না। ১৮৭২ সালের দ্বিতীয় বার কানিংহাম হরপ্পায় বেশকিছু পাত্র পান। দয়ারাম সাহানি হরপ্পার খোড়াখুড়ি করেন ১৯২০ সালে ও জন মার্শাল ১৯২৪ সালে তার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করেন। সেই থেকেই হরপ্পা সভ্যতায় কথা জানা যায়।
হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার :
হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার ছিল বিশাল অঞ্চল জুড়ে। জম্মুর মান্ডা এই সভ্যতার উত্তর সীমা, উত্তরে আফগানিস্তান, দক্ষিণী গুজরাট ও কচ্ছ, মহারাষ্ট্র এবং হরপ্পা সভ্যতার পশ্চিম সীমা বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তান পর্যন্ত, পূর্বদিকে আলমগিরপুর মোট সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত।
নগর পরিকল্পনা :
হরপ্পা সভ্যতার প্রধান দুটি নগর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে নগর পরিকল্পনা যথেষ্ট উন্নত ছিল। রাজপথ গুলি ছিল সোজা, প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন। রাস্তার দুধারে বাঁধানো ফুটপাত, ল্যাম্পপোস্ট ও ডাস্টবিন ছিল। উঁচু এলাকায় তৈরি ইমারতগুলিতে ছিলো অভিজাতদের বাসস্থান এবং নিচু অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বসবাস ছিল। মহেঞ্জোদারোতে একটি বিশাল স্নানাগার ছিল। এছাড়া ১৫০×২০০ গর্ভবতীর একটা শস্যাগারও ছিল, যেখানে শস্য মজুত করে রাখা হতো। এছাড়া হরপ্পা সভ্যতার পয়:প্রণালীও খুবই উন্নত ছিল।
মহেঞ্জোদারো স্নানাগার :
স্নানাগার কথার অর্থ হল স্নান করার জায়গা, মহেঞ্জোদারো ১৮০×১৮০ ফুট লম্বা ও চওড়া স্নানাগার পাওয়া গেছে যার গভীরতা ৮ ফুট। জলাশয় জল বের করা এবং ঢোকার ব্যবস্থা ছিল। এমনকি জল পরিষ্কার রাখার যথাযথ ব্যবস্থা ছিল।
হরপ্পা সভ্যতার শাসক :
মহেঞ্জোদারো একটা পুরুষ মূর্তি পাওয়া গেছে। তার চুল আঁচড়ানো, গালের চাপ দাড়ি, অর্ধেক বোজা চোখ, কাঁধ থেকে চাদর ঝুলছে, সম্ভবত তিনি হরপ্পা সভ্যতার প্রধান পুরোহিত বা প্রশাসক।
কারিগরি শিল্প :
এই যুগের কারিগরিও হয়েছিল উন্নত। ধাতুর মধ্যে তামা, কাঁসা ও ব্রোঞ্জের প্রচলন ছিল, লোহার ব্যবহার তারা জানতো না, তামা ও ব্রোঞ্জের বাটালি, ছুরি, কুঠার তৈরি করত। পোড়া মাটির পাত্রে নানা রকম রং করত। মাটি দিয়ে বাসন-কোসন, থালা, বাটি, জালা জাতীয় পত্র তৈরি করত। এখানে সুতোর কাজ বেশি হতো। কাঁচা ইট ও পোড়ানো ইট পাওয়া গেছে। সূক্ষ্ম বাটখারার খোঁজ পাওয়া গেছে।
হরপ্পা সভ্যতার সীলমোহর :
হরপ্পা সভ্যতায় প্রচুর সিলমোহর পাওয়া গেছে। এইগুলি নরম পাথরে তৈরি। শিলিগুড়ি জীবজন্তু ও লিপি খোদাই করা থাকত। ভিজে কাদামাটিতে সিলমোহরের চাপ দিলেও তা সোজা হত। এগুলো এক রকম সাদা জিনিস মাখানো হত। তারপর পড়ানো হতো। সিংওলা, মানুষ, ষাঁড়, গাছ ও কানিক নকশাযুক্ত সিলমোহর পাওয়া যায়।
হরপ্পার বাণিজ্য :
হরপ্পা সভ্যতায় তেইশটা সিলমোহর পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়ায়। এর থেকে বোঝা যায় দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এই দুটি দেশ জলপথে যোগাযোগ রাখত। সোনা, রূপা, তামা, দামি পাথর হাতির দাঁতের চিরুনি পাথরের তৈরি মূর্তি আমদানি করা হতো আর রপ্তানি হতো বার্লি, ময়দা তেল ও পশমজাত দ্রব্য। ইরান ও তুর্কমেনিস্থানের সাথে স্থলপথে বাণিজ্য চলত। বণিকরা মর্যাদা পেলেও মজুর ও শ্রমিকদের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। নগরের বাইরে কৃষকরা থাকতো। ঘোড়ার ব্যবহার এরা জানত না। এই সভ্যতার মানুষ ভারবাহী পশু যেমন - বলদ, গাধা, উঠের ব্যবহার জানতো, এছাড়াও নৌকা ও জাহাজে ব্যবহার করত। তবে হরপ্পার রাস্তায় গাড়ির চাকার ছাপ ছিল।
বন্দর নগর : লোথাল
গুজরাটি ভাষায় লোথ ও থল লোথাল কথাটি এসেছে। এর মানে হলো মৃতের স্থান। গুজরাটের ভোগাবোর নদীর তীরে ছিল হরপ্পা সভ্যতার বন্দর নগর লোথাল। এখানে জাহাজ ঘাটা ও সমাধি ক্ষেত্রের নমুনা পাওয়া গেছে। এখানে জাহাজ তৈরি ও মেরামত করা হতো। লোথালে দু চাকার গাড়ি, গয়না, নারী মূর্তি, দাবার গুটি ও বোতামের আকারের সিলমোহর পাওয়া গেছে।
হরপ্পার ধর্ম :
হরপ্পায় মাতৃপূজার চলছিল। এক যগীর মূর্তি রূপ পশুপতি শিবের পূজা করা হতো। এছাড়াও জীবজন্তু ও গাছপালার পূজা করা হতো। এই সভ্যতার গয়না ও মাটির পাত্র সহযোগে মৃতদেহের সমাধি দেওয়া হতো।
হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্যায় :
খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের পর থেকে বিশাল ও বৈচিত্র্যময় হরপ্পা সভ্যতার অবনতি ঘটতে থাকে। যে সমস্ত কারণে হরপ্পা সভ্যতার অবনতি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় তা নিম্নরূপ :
প্রথমত, মহেঞ্জোদারোর পাঁচিলের গায় কাদার চিহ্ন দেখে অনুমান করা হয় যে সিন্ধু নদীর বন্যার কারণে হরপ্পা সভ্যতার অবনতি ঘটে ছিল।
দ্বিতীয়ত, বৃষ্টিপাতের অভাবে হরপ্পা সভ্যতার কৃষি ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছিল সেই কারণে এই সভ্যতার অবনতি ঘটে ছিল।
তৃতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার নগর সম্প্রসারণের জন্য পাকা ইটের প্রয়োজন হতো। ঈদকে পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে গাছ কেটে কাঠের যোগান দিতে হতো। ফলে প্রচুর গাছ কাটার ফলে অনাবৃষ্টি হতো বলে মনে করা হয়।
চতুর্থত, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি এবং নগর শাসনব্যবস্থা দুর্বলতার কারণে হরপ্পা সভ্যতার অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করা হয়।
পঞ্চমত, বারবার বাইরে শত্রু আক্রমণের ফলে এই সভ্যতার অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ বলে ধরা হয়।
হরপ্পা সভ্যতার লিপি :
হরপ্পায় প্রাপ্ত লিপি অনেকটা সংকেত লিপির মত, তাতে ৩৭৫-৪০০ টাকার মতো চিহ্ন রয়েছে। এই লিপি ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হতো। দ্রাবিড় ভাষার সাথে হরপ্পা ভাষার খুব মিল ছিল। লিপি সাজিয়ে সাইনবোর্ডের মত জিনিস ঢোলাবিরা কেন্দ্র থেকে পাওয়া গেছে।
অনুশীলনী
প্রশ্ন : সিন্ধু নদীর তীরে হরপ্পা সভ্যতা শহরগুলি কেন গড়ে উঠেছিল বলে তোমার মনে হয়?
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতা কি ধরনের বাড়িঘর পাওয়া গেছে? সেগুলিতে কারা থাকছেন বলে মনে হয়?
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার সম্বন্ধে যা জানো লেখ।
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার কারিগরি শিল্প সম্পর্কে যা জানো উল্লেখ করো।
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা উল্লেখ করো।
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার লিপি সম্বন্ধে যা জানো লেখ।
প্রশ্ন : মেহেরগড় সভ্যতা কোথায় অবস্থিত? কত খ্রিস্টাব্দে কে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন?
প্রশ্ন : সিন্ধু সভ্যতা কে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয় কেন?
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বাণিজ্যিক ব্যাপারে যা জানো লেখ।
প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার অবনতির কারণ কি ছিল বলে তোমার মনে হয়?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ